ঢাকা শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ২৪ কার্তিক ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

হাসনাবাদ গণহত্যা: লাকসামের অমানবিক অধ্যায়

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬:০২ পিএম
হাসনাবাদ গণহত্যা: লাকসামের অমানবিক অধ্যায়

কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার হাসনাবাদ—একটি শান্তিপূর্ণ গ্রামীণ এলাকা, যা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায়ের সাক্ষী। ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার সকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এখানে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায়, যা 'হাসনাবাদ গণহত্যা' নামে পরিচিত। এই গণহত্যায় ৩১ জন নিরস্ত্র বাঙালি নাগরিক নিহত হয়, যাদের মধ্যে ছিলেন শিশু, নারী এবং বয়স্করা। এই ঘটনা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী হাসনাবাদ যুদ্ধের (১৩ সেপ্টেম্বর) প্রতিশোধ হিসেবে সংঘটিত হয়। হাসনাবাদ বাজার এবং তৎসংলগ্ন গ্রামগুলো—যেমন মানরা, আশিয়াদারী, নরপাইয়া এবং তালতলা—এই নির্যাতনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। আজ, ২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর—এই ঘটনার ৫৪তম বার্ষিকীতে—এই প্রতিবেদনটি ঘটনার পটভূমি, বিস্তারিত বর্ণনা, শহীদদের পরিচয় এবং পরবর্তী পরিণতি নিয়ে আলোচনা করবে, যাতে মুক্তিযুদ্ধের এই অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের সম্পূর্ণ ছবি উঠে আসে। এই গণহত্যা বাঙালি জাতির সহনশীলতা এবং প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

পটভূমি: হাসনাবাদ যুদ্ধ এবং প্রতিশোধের ছায়া

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করেছিল। লাকসাম এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল, যেখান থেকে তারা বাঙালি গ্রামগুলোতে নিয়মিত দমন-পীড়ন চালাত। এই গণহত্যার মূল ট্রিগার ছিল আগের দিনের হাসনাবাদ যুদ্ধ। ১৩ সেপ্টেম্বর, সোমবার, মুক্তিযোদ্ধারা এবং স্থানীয় গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাদের উপর এক সফল অভিযান চালায়। এতে ৮-১০ জন পাক সেনা নিহত এবং ১৪-১৫ জন আহত হয়। এই পরাজয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী পরের দিন প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। চিতোষী ক্যাম্প থেকে এবং লক্ষ্মণপুর হয়ে দুটি দল গঠন করে তারা হাসনাবাদে প্রবেশ করে। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্যরা, বিশেষ করে সাতপুকুরিয়ার শান্তি কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শামসুল হক (পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), পাক সেনাদের সহযোগিতা করে গ্রামের লোকজনের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে। এই পটভূমি থেকে বোঝা যায়, কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস পাকিস্তানি হানাদারদের হিংস্রতাকে উস্কে দিয়েছিল, যা বাঙালি গ্রামগুলোকে লক্ষ্য করে এক নির্মম প্রতিশোধমূলক অভিযানে রূপ নেয়।

ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা: নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডের এক দিন

১৪ সেপ্টেম্বর সকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোনো প্রতিরোধের মুখোমুখি না হয়ে হাসনাবাদে প্রবেশ করে। তাদের দুটি দল ছিল: একটি চিতোষী ক্যাম্প থেকে আসা, যারা হাসনাবাদ বাজারে ঢুকে দোকানপাটসহ আশপাশের সকল ঘরবাড়ি অগ্নিসংযোগ করে। এরপর তারা আশপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে নির্মম নির্যাতন শুরু করে—লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। অন্য দলটি পূর্বদিকের লক্ষ্মণপুর হয়ে আসে এবং সরাসরি মানরা, আশিয়াদারী গ্রাম, নরপাইয়ার মালেক মিয়ার বাড়ি এবং তালতলার বড়বাড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা মানরার মুন্সীবাড়ি এবং আশিয়াদারির ভূঁইয়াবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। নির্যাতনের মূল কেন্দ্র ছিল মানরা গ্রামের মুন্সীবাড়ি, যেখানে একসঙ্গে ৯ জনকে হত্যা করা হয়। পাক সেনারা অস্ত্রের গুলিতে এবং অন্যান্য নির্মম উপায়ে হত্যা করে, যাতে গ্রামবাসীরা কোনো প্রতিরোধ করতে না পারে। এই দিনে মোট ৩১ জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিলেন সাধারণ কৃষক, দোকানদার এবং তাদের পরিবারের সদস্য। গণহত্যার সময় মুন্সীবাড়িতে ৩ জন আহত অবস্থায় বেঁচে যান, যারা পরবর্তীকালে এই নির্মমতার সাক্ষ্য প্রদান করেন। এই ঘটনা ছিল এমন নির্মম যে, গ্রামের শান্ত পরিবেশ একদিনেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

শহীদদের পরিচয়: নিহতদের তালিকা

হাসনাবাদ গণহত্যায় নিহত ৩১ জনের মধ্যে বিস্তারিত নাম এবং অবস্থান নিম্নরূপ। নিম্নোক্ত টেবিলে শহীদদের নাম, পিতার নাম (যেখানে উল্লেখ আছে) এবং ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হলো:

ক্রমিক শহীদের নাম পিতার নাম / অতিরিক্ত তথ্য ঘটনাস্থল
হাছান মিয়া আবদুল আজিজ মুন্সী আশিয়াদারি গ্রাম
আবদুল আজিজ আবদুর রব আশিয়াদারি গ্রাম (ব্যাপারী বাড়ি)
আবদুল হামিদ আবদুর রব আশিয়াদারি গ্রাম (ব্যাপারী বাড়ি)
ইউসুপ আলী মুন্সী তিতা গাজী মানরা মুন্সীবাড়ি
কেরামত আলী মুন্সী তিতা গাজী মানরা মুন্সীবাড়ি
রোশন আলী মুন্সী তিতা গাজী মানরা মুন্সীবাড়ি
নোয়াব আলী - মানরা মুন্সীবাড়ি
আরব আলী নোয়াব আলী মানরা মুন্সীবাড়ি
সায়েদ আলী নোয়াব আলী মানরা মুন্সীবাড়ি
১০ তৈয়ব আলী নোয়াব আলী মানরা মুন্সীবাড়ি
১১ জিন্নত আলী মুন্সী তিতা গাজী মানরা মুন্সীবাড়ি
১২ মুসলিম মিয়া দুদু মিয়া (সাতখরিয়া নিবাসী, মানরা মুন্সীবাড়ির জামাতা) মানরা মুন্সীবাড়ি
১৩-১৬ ইউনুস মিয়া, চাঁন মিয়া, ইদ্রিস মিয়া, কামালউদ্দিন - মানরা গ্রামের পশ্চিমপাড়া
১৭ (অজ্ঞাত) - হাসনাবাদ চৌধুরী বাড়ি
১৮ (অজ্ঞাত) - জমিদার বাড়ি (তালতলা)
১৯-৩১ (অন্যান্য নিহত, নাম অজ্ঞাত) - হাসনাবাদ বাজার ও আশেপাশের গ্রাম

সার্বাইভার: মানরা মুন্সীবাড়িতে আহত অবস্থায় বেঁচে যান: হাজী নুরুল হক (পিতা রওশন আলী মুন্সী), একরামুল হক কালা মিয়া (পিতা রওশন আলী মুন্সী), এবং মো. জহিরুল ইসলাম।

পরিণতি এবং স্মৃতির সংরক্ষণ

গণহত্যার পর এলাকাটি পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়, কিন্তু ধ্বংসলীলার ফলে হাজারো মানুষ বাস্তুহারা হয়। শামসুল হকের মতো সহযোগীরা পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর হাসনাবাদে গণকবর এবং বধ্যভূমি হিসেবে স্থানগুলো চিহ্নিত হয়, কিন্তু অনেকগুলো অবহেলিত রয়েছে। কুমিল্লায় মোট ৩৫-৫০টি এমন বধ্যভূমি রয়েছে, যার মধ্যে হাসনাবাদেরটি অন্যতম। স্থানীয়রা বারবার স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছে, কিন্তু সরকারি উদ্যোগের অভাবে এগুলো ঝোপঝাড়ে ঢাকা পড়েছে। ২০১৯ সালের বিজয় দিবসে কিছু স্থানে স্মৃতিসভা হয়েছে, কিন্তু হাসনাবাদের জন্য নির্দিষ্ট স্মৃতিচিহ্ন এখনও অপূর্ণ। এই গণহত্যা লাকসামের মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ১০ হাজারেরও বেশি বাঙালির হত্যাকাণ্ডের অংশ, যা পাকিস্তানি ঘাঁটির কারণে ঘটেছে।

হাসনাবাদ গণহত্যা শুধু একটি স্থানীয় হত্যাকাণ্ড নয়, বরং পাকিস্তানি দখলদারদের জাতিগত নির্যাতনের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এই ৩১ শহীদের বলিদান স্বাধীনতার পথে অমূল্য অবদান রেখেছে। ৫৪তম বার্ষিকীতে আমাদের কর্তব্য হলো এই স্মৃতিকে জাগরূক রাখা, স্থানীয় স্তরে সচেতনতা বাড়ানো এবং স্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মাধ্যমে শহীদদের সম্মান রক্ষা করা। এটি ভবিষ্যত প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা দেবে।

সূত্র

- বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড [ইমন সালাউদ্দিন]।

- সংগ্রামের নোটবুক: ১৯৭১.০৯.১৪ | হাসনাবাদ গণহত্যা (লাকসাম, কুমিল্লা)।

- সংগ্রামের নোটবুক: ১৯৭১.০৯.১৩ | হাসনাবাদ যুদ্ধ (লাকসাম, কুমিল্লা)।

- খবরের কাগজ: কুমিল্লায় যত বধ্যভূমি।

- প্রথম আলো: অবহেলিত কুমিল্লার ৩৫টি বধ্যভূমি।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০