

ত্রিমোহনীতে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে ১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। এদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৫ জন নিরীহ বাঙালিকে একযোগে গুলি করে হত্যা করে। ভাগ্যক্রমে সেদিন প্রফুল্ল সরকার নামে একজন বেঁচে যান। ত্রিমোহনী ট্র্যাজেডির এই প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য থেকে আমরা জানতে পারি সেই করুণ ইতিহাস।
প্রফুল্ল সরকারের সাক্ষ্য
প্রফুল্ল সরকার তখন ২০ বছরের যুবক। ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল নেত্রকোনা শহরের শিবগঞ্জ রোড থেকে একদল রাজাকার তাকে বিনা কারণে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। থানা থেকে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়, এবং ম্যাজিস্ট্রেট তাকে জেলহাজতে পাঠান। তার মতো আরও ২৬ জনকে একইভাবে জেলহাজতে পাঠানো হয়, কিন্তু কেউই জানতেন না তাদের অপরাধ কী। দীর্ঘদিন হাজতবাসের পর কয়েকজন জামিনে মুক্তি পেলেও বেশিরভাগই জামিন পাননি।
২২ সেপ্টেম্বর ওই ২৬ জনকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। আদালত সকলকে নির্দোষ ঘোষণা করে বেকসুর খালাস দেন। কিন্তু আদালত থেকে মুক্তি পেলেও পাকিস্তানি সেনাদের হিংস্রতা থেকে তারা রক্ষা পাননি। কোর্ট হাজতে কিছুক্ষণ অবরুদ্ধ রাখার পর তাদের কাছের একটি রেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একজন সেনা কর্মকর্তা তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন। দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দড়ি দিয়ে সকলকে বেঁধে ফেলা হয়। এরপর মিলিটারি ট্রাকে করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ত্রিমোহনী ব্রিজে।
রাত ৮টার দিকে পাকসেনাদের রাইফেল গর্জে ওঠে। একের পর এক গুলিবর্ষণে নিমিষেই শহীদ হন ২৫ জন নিরীহ বাঙালি। তাদের নাম: সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহা রায়, কামিনী কুমার চক্রবর্তী, নিশিকান্ত সরকার, সুরেন্দ্র চন্দ্র দে, কমল চন্দ্র সাহা, সুনীল চন্দ্র সাহা, সতীশ চন্দ্র সরকার, দুর্গানাথ চক্রবর্তী, ব্রজেন্দ্র চন্দ্র সরকার, মতিলাল সাহা (১), মতিলাল সাহা (২), পীযূষ কান্তি সাহা, দীপক কুমার সাহা, দিলীপ কুমার পাল, সন্তোষ চন্দ্র পাল (১), সন্তোষ চন্দ্র পাল (২), রমেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, অজিত কুমার সাহা, সতীশ চন্দ্র সাহা, বিনয়ভূষণ সরকার এবং দীনেশ চন্দ্র সরকার।
প্রফুল্ল সরকারের অলৌকিক রক্ষা
ভাগ্যক্রমে সেদিন প্রফুল্ল সরকার বেঁচে যান। পাকসেনারা যখন তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি চালায়, তখন তিনি গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভান করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। হত্যাযজ্ঞ শেষে পাকসেনারা প্রত্যেকের লাশের সঙ্গে প্রফুল্ল সরকারকেও মগড়া নদীতে ফেলে দেয়। কিছুক্ষণ পর পাকসেনারা চলে যায়। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সারা রাত নদীর পানিতে হাবুডুবু খেয়ে অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে যান প্রফুল্ল সরকার। সেই দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, “২৫ জন শহীদের বুকের তাজা রক্তে সেদিন মগড়ার পানি লাল হয়ে ওঠে। এরপর স্রোতের তোড়ে লাশগুলো একসময় অদৃশ্য হয়ে যায়।”
স্থানীয় সহযোগীদের ভূমিকা
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় আলবদর ও রাজাকারদের সরাসরি সহযোগিতায় এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ত্রিমোহনী ব্রিজ মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি ভয়ঙ্কর বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল, যেখানে নিরীহ বাঙালিদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হতো।
সূত্র
মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত
মন্তব্য করুন